বাজার এবং গণতন্ত্ৰের বিপনন
কিংশুক চক্ৰবর্তী
![]() |
কিংশুক চক্ৰবর্তী |
এই বিশ্বে যেকোনো অধিকারের তুলনায় অর্থনৈতিক অধিকার খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ আৰ্থিক অধিকারকে অৰ্জন করতে প্ৰতিটি মানুষ এক সংগ্ৰামপূর্ণ জীবন যাপন করে চলেছে যেখানে কখনো কখনো নিজের জীবন যেন মূল্যহীন হয়ে যায়। নিরাপত্তাহীন জীবন যাপনকে বয়ে নিয়ে যাওয়া মানুষের কাছে রাজনৈতিক এবং নাগরিক অধিকারগুলির কোনো প্ৰাসঙ্গীকতা আছে কি ? কারণ যে সমাজ ব্যবস্থায় সর্বত্ৰ এক চরম অভাববোধ বিরাজ করছে সেখানে গনতান্ত্ৰিক তথা নাগরিক অধিকারগুলির অবস্থা বিলাসী সামগ্ৰীর মতোই ৷ যাকে দেখতে শুনতে ভালোই লাগে কিন্তু অর্জন করতেই যোগ্যতার প্ৰশ্ন এসে যায় । অথচ নীতিগত ভাবে গণতান্ত্ৰিক বা নাগরিক অধিকারগুলিকে অগ্ৰাহ্য করা যায় না কারণ এই অধিকারগুলির মধ্যে দিয়েই মানুষ বাস্তবিক ভাবে অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে অর্জন করতে পারে । যদি সমাজে মূল্যবোধের ভিত্তিতে গণতান্ত্ৰিক অধিকার বা নাগরিক অধিকারগুলির এবং অর্থনৈতিক অধিকারগুলির যুক্তিযুক্ততা বিচার করা যায় তাহলে যে চিত্ৰটি আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে পরবে সেটা খুব করুন এবং ভয়াবহ । সম্পদহীন গরীব মানুষের কাছে যদি পছন্দ করতে দেওয়া যায় তাহলে সে কাকে অধিক অগ্ৰাধিকার দেবে – নাগরিক অধিকারকে না অর্থনৈতিক অধিকারকে ? খুব স্বাভাবিক ভাবেই সে অর্থনৈতিক অধিকারকেই অগ্ৰাধিকার দিতে চাইবে ।দেখা গিয়েছে যে নির্বাচন সমাগত হলে উপঢৌকোনের রাজনীতি একেবারে সহজলভ্য হয়ে যায় । একটি অভাব জর্জরিত সমাজে মানুষ যখন তার প্ৰয়োজনীয় সামগ্ৰী কিংবা পরিসেবাকে খুব সহজে পেয়ে যায় তখন তাকে সহজেই গ্ৰহন করে কোনো মূল্যবোধের কথা চিন্তা নাকরে । অভুক্ত মানুষেরা কখনোই নাগরিক অধিকার বা গণতান্ত্ৰিক অধিকারবোধ ইত্যাদিকে নিয়ে ভাবেনা । এই ধরনেই মূল্যবোধের দ্বারা যখন দেশের গণতান্ত্ৰিক অনুশীলন পরিচালিত হয় তখন তারদ্বারা গণতান্ত্ৰিক ব্যবস্থায় বাজার বিপনন প্ৰক্ৰিয়া চলে আসে। অর্থাৎ ব্যালটকে অর্জন নয় বিপননের দ্বারা কিনতে হয় ।সুযোগ বঞ্চিত এবং শোষিত সমাজে কিছু টাকা বিনিয়োগ করলেই গণতান্ত্ৰিক ক্ষমতা স্বয়ংক্ৰিয় ভাবে কিছু মানুষের হাতে কেন্দ্ৰীভূত হয়ে যায়। সম্ভবত সেইজন্যই আজকের নির্বাচনে বিপনন করা হচ্ছে সেই গরীবদের বঞ্চনাগুলিকে , যেমন গরীবদের রোজগার, গরীবদের স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, নিরাপত্তা ইত্যাদি। আগুন দেখলেই পতংগ যেমন ছুটে আসে তেমন কিছু প্ৰতিশ্ৰুতি কিংবা উপঢৌকন দিলে হা-ভাতে সমাজ ছুটে আসে। আগুনে পরে পতংগে অস্তিত্ব ছাই হয়ে যায় এবং প্ৰতিশ্ৰুতি কিংবা উপঢৌকনে নষ্ট হয়ে যায় মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারগুলি।
যে সমাজ ব্যবস্থায় বেঁচে আছি তাতে সব চাইতে বেশি প্ৰভাব ফেলছে বাজার এবং বিপনন । উৎপাদন যেমন তেমন হোক না কেন, প্ৰচার হওয়া চাই ঢাক-ঢোল বাজিয়ে । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আধুনিক বাজার কেন্দ্ৰীক সমাজ ব্যবস্থায় তথাকথিত ‘বাদ’ বা ‘তন্ত্ৰে’র মৌলিকতা বেশি দিন ধরে স্থায়ী হতে পারছেনা । বিশ্বের কোনো দেশেই এখন বিশুদ্ধ সমাজতন্ত্ৰ খুঁজে পাওয়া যায়না কিংবা বিশুদ্ধ পুঁজিবাদকে পাওয়া যায়না । সব কিছুতেই বাজারের প্ৰলেপ লেগে গিয়েছে। আজকের সমাজ ব্যবস্থায় রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ইত্যাদি যেকোনো ক্ষেত্ৰে যেসব সুযোগ সুবিধা তৈরি হচ্ছে তার বিপরীতে বাজারের ভূমিকা সব চাইতে বেশি। সে দিক দিয়ে বিচার করলে দেশের সংবিধান কিংবা রাষ্ট্ৰ যন্ত্ৰের ভূমিকাও বাজার শক্তির সামনে ধীরে ধীরে নিষ্ক্ৰিয় হয়ে আসছে । ১৯৭০ সালের পর থেকে পুঁজিবাদী দেশেগুলির প্ৰরোচনায় গোটা বিশ্বে ‘বিশ্বায়ন’ প্ৰক্ৰিয়ার সম্প্ৰসারন করা হয়েছিলো যা কিনা এক কথায় বাজার ব্যবস্থার বিকাশের অন্যতম এক কৌশল ছিলো মাত্ৰ। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এবং অন্যান্য কিছু আান্তর্জাতিক সংগঠনের প্ৰত্যক্ষ সহায় সহযোগিতায় আজ বাজার ব্যবস্থা একেবারে মুক্ত ভাবে বিচরন করছে নগর থেকে গ্ৰাম পর্যন্ত। উন্নত দেশে থেকে একেবারে হা-ভাতে দেশ পর্যন্ত । বাজার ব্যবস্থার ব্যপক বিস্তারকে আধুনিক অর্থনীতিতে বলা হচ্ছে ‘বাজার মৌলবাদ’। সাধারনতে মৌলবাদ হচ্ছে কোনো একটি মতবাদকে অন্ধের মত অনুসরণ করে চলার প্ৰবনতা । সাম্প্ৰতিক বিশ্বের প্ৰায় প্ৰতিটি দেশে প্ৰতিটি বিষয়ে কেবল বাজারকে অগ্ৰাধিকার দেওয়া হচ্ছে ।
উল্লেখযোগ্য যে বিশ্বায়নের পরে বিশ্বের বিশেষত অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলিতে বৈদেশিক মূলধন বিনিয়োগ যথেষ্ট হয়েছে এবং সেইজন্য বাজার ব্যাবস্থার এক সম্প্ৰসারন হয়েছে যে অবশেষে ব্যাহিক প্ৰভাব (Externalities) তৈরী করেছে । এই বাহ্যিক প্ৰভাব হচ্ছে সেইগুলি প্ৰভাব যেখানে বাইড়ের কোনো তৃতীয় প্ৰতিনিধি উপকৃত কিংবা অপকৃত হয়, এবং সেই উপকারের জন্য তাঁরা কোনো মূল্য পরিশোধ করেনা বা অপকারের জন্য কোনো ক্ষতিপূরন পায়না । যেমন ধরা হলো একটি নদী বান্ধ নির্মান করার জন্য কিংবা রেললাইনের সম্প্ৰসারনের জন্য কিছু মানুষ তাঁদের ভিটে মাটি থেকে উচ্ছেদিত হলো । এইসব বুনিয়াদী ব্যবস্থার নির্মানের জন্য অবশ্যই দেশের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়বে এবং আয় বাড়েবে কিন্তু যাঁদের উচ্ছেদ করা হলো , যাঁরা জীবিকা হারালো তাঁদের যদি ক্ষতিপূরন দেওয়া নাহয় তাহলে সেই বিনিয়োগ জনিত নির্মান কাজে এক প্ৰকারের নেতিবাচক বাহ্যিক প্ৰভাব থেকে যায় । এই ধরনের সমস্যা দেশের ভিতরে হতে পারে কিংবা আন্তর্জাতিক ভাবেও হতে পারে । এই বিনিয়োগ জনিত কাজগুলির জন্য অবশ্যই আয়, নিয়োগ, উৎপাদন বাড়ছে কিন্তু তার বিপরীতে নেতিবাচক প্ৰভাবগুলিও কম নয় । যেমন পরিবেশ প্ৰদূষণ, মানুষের উচ্ছেদ এবং প্ৰব্ৰজন , নিয়োগহীনতা , পরিবেশের জৈব বৈচিত্ৰের পতন ইত্যাদি । এই নেতিবাচকতার কোনো ক্ষতিপুরন বাজার কি দেয় না চেয়ে পাওয়া যায় । আজকের বিকট সম্ৰাজ্যবাদী বাজার ব্যবস্থার প্ৰভাব অবশেষে মানবিক সমাজেই অধিক ভাবে পরেছে কিন্তু যে ক্ষতি হয়েছে তার পূরন হয়নি । তাহলে বাজার কেন্দ্ৰীকতা নিশ্চিত ভাবে বহনযোগ্য বিকাশ আনতে অক্ষম ।
সামাজিক জীবনে ভালো ভাবে বাঁচতে হলে কিছু অধিকার থাকা প্ৰয়োজন এবং এই অধিকারগুলি প্ৰদান করছে দেশের সংবিধান কিংবা আইন প্ৰশাসন ব্যবস্থা ইত্যাদি । কিন্তু বাজার শক্তির সামনে ধীরে ধীরে সেই সব অধিকারগুলি যেন সংকোচিত হয়ে আসছে । উদাহরন স্বরূপে ধরে নেওয়া যাক শিক্ষার অধিকারকে। আজকের সমাজে শিক্ষা পরিনত হয়েছে একটি বিপননযোগ্য পন্য-সামগ্ৰীতে এবং এখানেও প্ৰচুর পরিমানে দেশ বিদেশের করপোরেট খন্ড বিপুল পরিমানে টাকা বিনিয়োগ করছে । সুতরাং যাঁর হাতে যথেষ্ট ক্ৰয়ক্ষমতা আাছে তাঁরা বাজার থেকে উত্তম শিক্ষা পরিসেবাকে কিনে আনতে সক্ষম হয়েছে । যাঁদের নেই তাঁদের জন্য আছে বিনামূল্যের সার্বজনীন শিক্ষা । সমাজে এখন স্পষ্ট হয়ে পরেছে যে বাজার ব্যবস্থা ধীরে ধীরে শিক্ষার অধিকারকে টাকার মাধ্যমেই মূল্যায়ন করতে সক্ষম হয়েছে । ঠিক সেইভাবে দেশের শ্ৰম বাজারের অবস্থাও তথৈবচ । একমাত্ৰ সংগঠিত খন্ডে নিয়োজিত শ্ৰমিকেরা শ্ৰম আইন অধিকার সংক্ৰান্তীয় সুবিধাগুলিকে ভোগ করতে পারছে কিন্তু তার বিপরীতে অসংগঠিত খন্ডের শ্ৰমিকেরা বহন করছে এক বিপুল বঞ্চনা । যেমন দক্ষিন পূর্ব এশীয়ার জনবহুল দেশগুলিতে বিদেশী বিনিয়োগ হওয়ার অন্যতম কারন কম মজুরির শ্ৰমিক। কম মজুরি দিয়ে মানুষকে সত্যিকারে আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বি করা যাচ্ছে কি ? সুতরাং এইসব অধিকারের জায়গায় ধীরে ধীরে বাজার ব্যবস্থা সংক্ৰমণ করছে এবং হয়ত সেইজন্য দেশের গণতন্ত্ৰে প্ৰাসংগিক হয়েছে “of the people, by the people and against the people’’ । অর্থাৎ গণতন্ৰেসংর উচিত ছিলো মানুষের সক্ষমতাকে শক্তিশালী করতে এগিয়ে যাওয়া সেখানে বাজারের প্ৰভাবে তৈরি হলো সুযোগ বঞ্চিত মানুষের । এধরনের সুযোগ বঞ্চিত মানুষেরা নিজের আর্থিক স্বাধীনতাকে অর্জন করতে কখনো সাংবিধানিক অধিকার কিংবা গণতান্ত্ৰিক আদর্শের অনুশীলনকে উপেক্ষিত করতে বাধ্য হয় । যেখানে স্বাভাবিক ভাবে নিজের জীবন যেন মূল্যহীন হয়ে যায় । এমন উদাহরন এখনকার সমাজে ক্ৰমান্বয়ে সহজলভ্য হয়ে উঠেছে যেমন চাষীর আত্মহত্যা, সামান্য টাকার জন্য নিজের সন্তানকে বিক্ৰী করছে, অসহায় বাবা মাকে ফেলে আসছে, বাড়ছে শিশুশ্ৰমিকের সংখ্যা ইত্যাদি । আর্থিক বিকাশে মানুষের গণতান্ত্ৰিক অধিকারগুলিকে অগ্ৰাধিকার দেওয়া খুবই প্ৰয়োজনীয় । কিন্তু বাস্তবিকতা হচ্ছে যে বর্তমান সময়ে রাষ্ট্ৰের উন্নয়ন নীতির প্ৰশ্ৰয়ে বাজার ব্যবস্থার যে ব্যাপক বিকাশ হয়ে চলেছে তার পরিপ্ৰেক্ষিতে বলা যেতে পারে যে আগামী দিনে সাধারন শ্ৰমজীবি মানুষের স্ব-ক্ষমতা ক্ষতিগ্ৰস্ত হতে চলেছে । শাসন ব্যবস্থার মধ্যে গণতন্ত্ৰকে সবচাইতে অধিক অগ্ৰাধিকার দেওয়া হয় কিন্তু আজকের দিনে সম্ৰাজ্যবাদী বাজারের শক্তির কাছে গণতন্ত্ৰ তার স্বকীয়তা , অর্থাৎ জনমুখী গুণকে ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছে ।
XXX
Dr Kingshuk Chakraborty
Department of Economics, Bilasipara College
P.O. Bilasipara
Dist: Dhubri (Assam)
PIN: 783348
একদম ঠিক
উত্তরমুছুন